খুলনা, বাংলাদেশ | ২১শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৫ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  চুয়াডাঙ্গায় ট্রাকের চাপায় ইজিবাইকের চালকসহ নিহত ৩
  চুয়াডাঙ্গায় ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত : খুলনার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ
  খুলনা নগরীর ওয়েস্টার্ন ইন হোটেল থেকে নারীর লাশ উদ্ধার

খুমেক হাসপাতালের হিমাগার বিকল : মর্গে লাশ নিয়ে স্বজনদের ভোগান্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

পারিবারিক কলহের জেরে খুলনা জোড়াগেট এলাকার গৃহবধু মাহিনুর বেগম গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিবেশীরা বুধবার বিকেল ৫ টার দিকে ওই গৃহবধুকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের জানান মাহিনুর বেগমের মৃত্যু হয়েছে।

বিষয়টি পুলিশ কেস হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করে। সময় অতিবাহিত হওয়ার কারণে লাশটি সংরক্ষণের জন্য পরিবারের সদস্যরা কর্তৃপক্ষকে হিমাগারে নেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু হিমাগারটি নষ্ট থাকায় কারণে মাহিনুর বেগমের লাশটি মর্গে ফেলে রাখা হয়। পরবর্তীতে পরিবারের সদস্যরা বরফ এবং পলিথিন ক্রয় করে দেওয়ার পর সেটি সংরক্ষণ করা হয়।

২৫ জুন দুপুরে খুলনার রূপসা উপজেলার চন্দনশ্রী গ্রামে একটি নির্মানাধীন স্কুলের দু’তলা ভবন থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন বাগেরহাট জেলার হাকিমপুর ইউনিয়নের হানিফ শেখের ছেলে মইনুল ইসলাম। প্রথমে স্থানীয়রা তাকে কাজদিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং সেখান থেকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে আসার আগে তার মৃত্যু হয়।

এরপর শুরু হয় আইনানুগ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা গ্রহণ শেষ হতে না হতেই শেষ হয়ে যায় ময়নাতদন্তের সময়। পরে লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় পরিবারের সদস্যদের। লাশ সংরক্ষণ করার জন্য গুণতে হয় নগদ দু’হাজার টাকা।

এ অভিযোগ শুধু মাহিনুর বেগম এবং মাইনুল ইসলামের পরিবারের নয়। অনেকেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন। মেরামত না করার কারণে দীর্ঘ ৮ বছরের অধিক সময় ধরে নষ্ট হয়ে আছে হাসপাতালের হিমাগার। আর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের সদস্যদের।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খুলনা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের মোট ১৫ টি হিমাগার ৮ বছরের অধিক সময় ধরে নষ্ট হয়ে আছে। যা মর্গের ডোম থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টার দিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে কথা হয় মাহিনুর বেগমের স্বামী রমাজান মুন্সির সাথে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ঝিনাইদহ সদরের গান্না এলাকায় তাদের আদি বসবাস। জীবন এবং জীবিকার তাগিদে তারা উভয় খুলনার জোড়াগেট গরুর হাট সংলগ্ন একটি বস্তিতে ভাড়া থাকেন। বুধবার বিকেলে পারিবারিক কলহের কারণে স্ত্রী গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করে। বাড়িতে না থাকায় প্রতিবেশীরা মরদেহটি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। পরে শুরু হয় বিভিন্ন বাহানা। লাশটি হাসপাতাল থেকে মর্গে প্রেরণ করার পর পচনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ডোমদের অনুরোধ করা হয় হিমাগারের রাখার জন্য। সেখান থেকে জানানো হয় ফ্রিজ নষ্ট থাকার কারণে ফ্রিজিং করা সম্ভব নয়। ফ্রিজ করার জন্য প্রয়োজন বরফের। পরিবারের সদস্যরা টাকা সংগ্রহ করে ৭ নং মাছ ঘাট থেকে বরফ এনে মাহিনুর বেগমের মরদেহটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে।

মাহিনুর বেগমের ছোটভাই মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, সংবাদ শুনে সকালে এখানে এসেছি। ফ্রিজিং ব্যবস্থা না থাকায় বরফ দিয়ে তার বোনের মরদেহটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। বরফ গলে পানি এবং সেই পানির মধ্যে বোনের লাশটি ভেসে থাকতে দেখে মন খুব খারাপ হয়ে যায়। এটা একটা অমানবিক কাজ। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চিকিৎসার জন্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানে এই দশা। মানুষ পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু স্বভাবের কোন পরিবর্তন হয়নি। কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং উদাসীনতার কারণে হাসপাতালের এই দশা।

রূপসা নৈহাটি এলাকার বাসিন্দা আবু শাহাদাৎ রনি বলেন, ২৫ জুন তার বাবার সাইটে কর্মরত শ্রমিক মইনুল ইসলাম অসাবধনতা বশত চন্দনশ্রী গ্রামের একটি নির্মানাধীন ভবন থেকে পড়ে যান। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরবর্তীতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তার মৃত্যু হয়। বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার আগে ময়নাতদন্তের সময় পার হয়ে যায়। তাই রাতে মরদেহটি মর্গে রাখতে হবে বলে সেখানকার কর্মরত ডোম আব্দুর রহিম জানায়। লাশটি সংরক্ষণের কথা বললে হিমাগার নষ্ট বলে তাকে জানানো হয়। পরবর্তীতে মরদেহটি সংরক্ষণের জন্য তিনি রনির কাছে দু’হাজার টাকা দাবি করেন। অবশেষে তাকে দু’হাজার টাকা দিয়ে মরদেহটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

খুলনা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের ডোম সুশীল এবং সজল কুমার বলেন, ফ্রিজ ২ টা। তাতে ৯ টা বক্স রয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে দু’টা ফ্রিজই অকার্যকর হয়ে পড়ে রয়েছে। সেখানে কোন লাশ রাখা যায়না বা ঠান্ডা হয়না। মৃতের পরিবার ব্যবস্থা করলে তা সংরক্ষণ করা হয় তা না হলে গরমের সময়ে ব্যাপক অসুবিধা হয়। ফ্রিজ থাকলে ভাল হত বলে তারা জানান।

জানতে চাইলে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোহাসিন আলী ফারাজী বলেন, এটা স্পর্শকাতর বিষয়। হিমাগারের ফ্রিজ ২০১৭ সাল থেকে নষ্ট এটা ঠিক নয়। একটি ফ্রিজের মধ্যে ছয়টি ট্রে থাকে। সেগুলো খুব উন্নতমানের। যখন ফ্রিজগুলো ইনষ্টল করা হয়েছিল তখন থেকে তা চালু ছিল। একটা ট্রে নষ্ট হওয়ার কারণে আমরা ৪টি ট্রে দিয়ে ফ্রিজগুলো চালিয়েছি। সর্বশেষে দু’টি দিয়ে আমরা কার্যক্রম চালিয়েছি। ফ্রিজগুলো যে পাওয়ার শোষণ করে তা একটি ট্রে চালানো সম্ভব নয়। তাছাড়া এক একটি মেরামত করতে ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে ফ্রিজগুলো মেরামত করেছি। গত একমাস আগে নিমুতে মিটিং হয়েছে। সেখানে ফ্রিজগুলো মেরামতের বিষয়ে কথা হয়েছে। তারা আন্তরিকভাবে কথাগুলো শুনেছে এবং নোট নিয়েছে। নতুন কোন মেশিন দেওয়া যায় কি না সেটা তারা নতুন অর্থ বছরে সিদ্ধান্ত নিবে।

তিনি বলেন, একটি মরদেহ রাখা ব্যয়-সাধ্য ব্যাপার। প্রতিদিন রাখার জন্য এক হাজার টাকা গুণতে হয়। সবচেয়ে বেশী সমস্যা হয় বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রে। সব মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে থাকার কারণে লাশ বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়।

খুলনা গেজেট/সাগর /এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!